সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা (আরএসটিপি) (২০১৫-৩৫)
পটভূমি
২০১১ সালে ঢাকা মেট্টোপলিটন এলাকায় জনসংখ্যা ছিলো ৯.৩ মিলিয়ন। বর্তমানে ঢাকা মেট্টোপলিটন এলাকায় যান্ত্রিক অযান্ত্রিক যানবাহনের মিশ্রণে সৃষ্ট যানজট বিশৃঙ্খলা উদ্বিগ্নের কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সাথে স্বাস্থ্য ঝুঁকি গুরুতর হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রমাগত উন্নয়ন এবং জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির সাথ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মোটর গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে একই সাথে বায়ু দূষণ, যানজট সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করবে। এরই প্রেক্ষিতে যানজট কমাতে এবং পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি রোধ করতে ঢাকা মেট্টোপলিটন এলাকায় গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নতিকরণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছি।
এই পরিস্থিতির বিবেচনায়, বাংলাদেশ সরকার (জিওবি) বিশ্বব্যাংকের (ডব্লিউবি) সহযোগিতায় ২০০৫ সালে “ঢাকার জন্য কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা” (এসটিপি) (২০০৪-২০২৪) প্রণয়ন করে। এসটিপি-তে “২০-বছরের নগর পরিবহন নীতি (২০০৪-২০২৪)” অন্তর্ভুক্ত ছিল, এবং অগ্রাধিকার বিষয়গুলির চিহ্নিতকরণ, যেমন গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নতি (বাস এবং রেল পরিবহন), শহুরে এক্সপ্রেসওয়েগুলির উন্নয়ন, এবং স্বয়ংক্রিয় প্রতিষ্ঠান যা প্রয়োজনীয় পরিবহন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে।
পরবর্তীতে দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সহ নানাবিধ কারনে অনুমান করা হয়েছে ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার রাজউক অধ্যুষিত এলাকায় জনসংখ্যা হবে ২৬.৩ মিলিয়ন। ফলশ্রুতিতে নগরায়ণ বিস্তার, যান্ত্রিক যানবাহনের দ্রুত বৃদ্ধি, জীবনযাত্রা এবং জীবনমান হ্রাস, অর্থনৈতিক অবস্থার স্থবিরতাসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হবে। এই প্রেক্ষিতে কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা সংশোধন এর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা (২০১৫-৩৫) খসড়া প্রণয়ন করা হয়।
উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যান্য শহর ও নগরগুলোর নগর প্রবৃদ্ধি, ব্যক্তিগত গাড়ির অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিত চলাচল নগরের বাসিন্দাদের সমন্বিত করার ক্ষেত্রে কষ্টকর হবে। একই সাথে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নগর পরিবহণ ব্যবস্থা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রধান যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবে।
নগরের ভবিষ্যত জীবনযাপন ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পরিবহণ খাতকে আধুনিক এবং এগিয়ে রাখতে সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নগরের জনগন এবং সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় নগর পরিসেবাগুলিতে গতিশীলতা এবং প্রবেশযোগ্যতা নিশ্চিত করা, মোট শহরের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি অংশ গণপরিবহণ ভিত্তিক নগরের উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং সাম্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামগ্রিক পরিবহণ লক্ষ্যমাত্রায় নিশ্চিত করতে হবে।
সংশোধিত এসটিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা নগরের গণপরিবহন প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যানজট নিরসন এবং বায়ু দূষণ নিরসন সম্ভব হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। একই সাথে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রেক্ষিত এবং উচ্চ-অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলির তালিকা প্রতিফলিত করবে।
প্রকল্প এলাকা
কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনায় উল্লেখিত বৃহত্তর ঢাকা ঢাকা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদী জেলা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনার প্রকল্প এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। এবং বাস্তবায়নকারি সংস্থা হিসেবে জাইকা ও ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)
সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য
সক্রিয় সামাজিক জীবন, জনঘনত্ব বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত গাড়ির অত্যাধিক ব্যবহার এবং কৌশলগত হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিবহণ অধ্যয়ণ একটি শহরের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে তুলবে। একই সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বয়স্ক ও নানা বয়সের জনসংখ্যার জন্য ভিন্ন মানের পরিবহণ পরিষেবা নিশ্চিত করা, ঢাকাকে বাসযোগ্য করা, অর্থৈনিতক স্থবিরতা হ্রাস সহ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে পরিবহণ খাতকে নকশার মাধ্যমে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কার্যকর টেকসই গনপরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপত্তা, সুবিধা এবং সাম্যতা সমন্বিত পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ এবং সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নগর পরিষেবা গতিশীলতা এবং প্রবেশযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ।
সংশোধিত পরিবহণ পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনে প্রতিটি লক্ষ্যে একাধিক পরিবহন উন্নয়ন নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনায় আটটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা হয়েছে
- নগর পরিবহণ সমস্যা সম্পর্কে সামাজিক প্রচারশক্তির প্রসার
- নগর বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থাপনা
- গণপরিবহণ এর উন্নয়ন এবং প্রসার
- কার্যকর ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনা
- কার্যকর ট্র্যাফিক চাহিদার ব্যবস্থাপনা
- বিস্তৃত পরিবহণ স্থান এবং পরিবেশ উন্নয়ন
- ট্র্যাফিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করা
- নগর পরিবহণ প্রশাসনিক এবং ব্যাপস্থাপনা সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ
কৌশলসমূহ
এছাড়াও মহাপরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেগুলো নিম্নরূপ
গণপরিবহণ শক্তিশালীকরণ; টেকসই গণপরিবহণ ব্যবস্থা এবং সর্বোচ্চ যাতায়াত সুবিধা প্রদান
আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার উন্নয়নঃ কার্যকর পরিবহণ ব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে ১০ মিলিয়ন মাল্টি হাব নগর উন্নয়ন
পরিবেশবান্ধব এবং সুপরিচালিত শহরঃ উদ্ভাবনী চিন্তাধার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক স্কিম এর মাধ্যমে পরিবহণ খাওতকে সক্ষম এবং পরিবেশ এর সাথে একত্রীকরণ।
তাৎক্ষণিক যানজট প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ: স্বল্প ব্যয়বহুল মাপকাঠি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যানজট সমস্যার দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করণ।
কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য সমস্যা সমূহ
নিরাপত্তা, ফুটপাত, গণপরিবহণ, অযান্ত্রিক যানবাহন, ভ্রমণ চাহিদা ব্যবস্থাপনা, নগর মালামাল পরিবহণ , গণপরিবহন, মিশ্রণ ব্যবস্থা, যানজট ব্যবস্থাপনা, পার্কিং, পরিবেশ, পরিবহণ এবং ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব, প্রাতিষ্ঠানিক এবং আর্থিক, বেসরকারীকরণ, নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ এবং ভর্তুকি সহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন ও বিবেচনায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনায় ছয়টি মূলনীতি ছিলো
- পথচারী বান্ধব নীতি
- আঞ্চলিক সড়কের উন্নয়ন এবং সংস্কার
- ৫৪টি নতুন রাস্তা এবং তিনটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ
- তিন লাইন বিশিষ্ট বাস র্যাপিড ট্রানজিট উন্নয়ন ( বি আর টি লাইন-১,২,৩)
- তিন লাইন বিশিষ্ট মেট্টোলাইন (লাইন-৪,৫,৬)
- পার্শ্ববর্তী নৌপথ উন্নয়ন
পরবর্তীতে কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনার মূলনীতি গুলো বিশদভাবে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনায় অনুমোদিত হয়। সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনায় ঢাকাকে ঘিরে দুই স্তরের বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ কর্মসূচী গৃহীত হয়। একই সাথে বিআরটি তে তিনটি লাইন হ্রাস হয়ে দুইটি লাইন প্রস্তাব করা হয়েছে। মেট্টোলাইন তিনটি থেকে পাঁচটি লাইন প্রসারিত করা হয়েছে এবং অন্যান্য পরিকল্পনার চেয়ে মেট্টোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও জাইকা কর্তৃক প্রণীত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩৫ সাল নাগাদ মোটরচালিত যাত্রীর প্রতিদিন ট্রিপ চাহিদা হবে ৩৫ মিলিয়ন। এরই প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, গণপরিবহন (বি আর টি, সিএনজি, ট্যাক্সি, ও অন্যান্য যানবাহন) বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী বৃদ্ধি হ্রাস পাবে, জাইকা প্রস্তাবিত পাঁচ বা ততোধিক মেট্রো লাইন, পাঁচটি লাইনে উন্নীত হবে, মোট মোটর চালিত পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে ধারণক্ষমতার প্রান্তিক ভলিউম বহন করবে এবং বাস ও মিনি বাসগুলি মোট নতুন পরিবহন যাতায়াতের চাহিদার অবশিষ্ট ৪৫ শতাংশ বা তার বেশি যাত্রী বহন করবে।
এসটিপিতে নগর পরিবহন নীতিমালা প্রণয়নের পর প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে, নগর পরিবহনের আশেপাশের পরিবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, এবং বিভিন্ন সমস্যা প্রকাশ পেয়েছে। এই সমস্যা উত্তীরণে পরিবহণ মহাপরিকল্পনায় প্রস্তাবিত স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পগুলি চালু করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে প্রকল্পগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদ্যোগ অবিলম্বে প্রয়োগ করতে হবে।
আমাদের বিশেষ প্রতিবেদনটি লিখেছেন পরিকল্পনাবিদ হোসনে আরা আলো ও পরিকল্পনাবিদ মোঃ রেজাউর রহমান
তথ্যসূত্রঃ জাইকার রিপোর্টের ডাউনলোড